কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের সজাগ থাকতে ও স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মন্থর করার জন্য আমাদের যতটা সম্ভব ঘরে থাকতে হবে।
এই অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাসের প্রভাববিস্তার রোধ করা খুব জরুরি। তাই বাংলাদেশ জুড়ে অনেক সংস্থাই এখন তাদের কর্মচারীদের ঘরে বসে নিরাপদে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে ঘরে বসে কাজ করা অনেক কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা তাদের কর্মজীবনে নিয়মিত ভ্রমণ করেন এবং অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন। তাই কাজটি সহজ করার জন্য আমরা এখানে ৭টি উপায় সংকলন করেছি, যা দিয়ে আপনি বাড়িতেই এমন একটি অফিস তৈরি করতে পারবেন যেখানে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন। সেই সাথে নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে নিরাপদ রাখতে পারেন।
প্রতিষ্ঠাপন
আমাদের অনেকেরই আগে থেকেই বাসায় বসে অফিসের কাজ করার জন্য আলাদা কোন স্পেস নেই। যদিও থেকে থাকে, সেটা ফুল টাইম কাজের জন্য উপোযোগী নাও হতে পারে। আপনি যদি শূন্য থেকে শুরু করে থাকেন, তবে প্রথমেই অফিসের কাজের জন্য উপযোগী জায়গা পছন্দ করাই হবে হোম-অফিসের ভিত্তি স্থাপন। ঘরের আবদ্ধ কোণাগুলো অথবা বাড়ির বাড়তি ঘরগুলো আগেই বাদ দিতে হবে, কারণ নিষ্প্রভ নির্জীব যায়গা আপনার কর্মক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বরং আপনার উচিৎ হবে আপনার কাজের ধরণ অনুযায়ী জায়গা বিন্যাস করা- এটি এমন একটা সুবিধা যেটা কেবল বাড়িতেই পাওয়া যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ও চিরাচরিত কর্মক্ষেত্রে নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, বেশ কয়েকটি বৈদ্যুতিক সকেটযুক্ত একটি দেয়াল আপনার জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে যদি আপনি নানান গ্যাজেটস যেমন কম্পিউটার, ক্যামেরা, ব্যাটারি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন। আপনার কাছে যদি একটি উপযুক্ত অফিস টেবিল না থাকে তবে আপনি কেবল ফোল্ড করা যায় এমন টেবিল, ওথবা কফি টেবিলও ব্যাবহার করতে পারেন – কাজ চালানোর জন্য যেটাই ঘরে থাকে।
নান্দনিকতার উপরে স্বাচ্ছন্দ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া
যখনই কর্মক্ষমতার ব্যাপারটা আসে, অফিসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা বাধ্যতামূলক। পিঠে ব্যাথা আর ক্লান্তি অবশ্যই আপনার কর্মক্ষমতাকে ব্যাহত করবে। হোম-অফিসের পেছনে মূলমন্ত্রটি হবে এমন একটি স্পেস যেখানে আপনি থাকতে চান এবং যেখান থেকে কাজ করতে ভালোবাসেন (যেখানে আপনাকে থাকতে হবে এমন যায়গা নয়)। তাই ডাইনিং চেয়ার ব্যবহার না করাটাই সমীচীন। হেলানো চেয়ার অথবা চাকাযুক্ত অফিস চেয়ার হবে সঠিক পছন্দ। কিন্তু আপনার কাছে যদি অফিস চেয়ার না থাকে তবে গদিযুক্ত চেয়ার বেছে নিন। সেটাও না থাকলে চেয়ারে বালিশ বসিয়ে নিন। আপনার বসার ব্যাবস্থাকে আরামদায়ক করতে ভ্রমণের জন্য ব্যাবহৃত ঘাড়-বালিস ভালো কাজে দেবে।
আপনার সর্বাধিক আরামের জন্য আরও কিছু ট্রিক্স হলো, আপনার কম্পিউটার মনিটর অথবা ল্যাপটপের পর্দাকে চোখের সমান্তরাল অথবা তার আরেকটু নিচে রাখা, যেন ঘাড়ে অতিরিক্ত চাপ না পরে আর চোখে ক্লান্তি না আসে। আপনার কিবোর্ড মেঝের সমান্তরালে রাখুন এবং আপনার চেয়ারটি এমন ভাবে বসান যেন আপনার পা দুটি মেঝেতে আরামপ্রদ ভাবে থাকে। এই সহজ নিয়মগুলো মেনে চললে আপনার কাজের সময়টা সহজ, স্বচ্ছন্দ ও ফলপ্রসূ হবে।
যথেষ্ট লাইটিং নিশ্চিত করা
অন্ধকারে পড়া অসহনীয়, আর এর ফলে আপনার চোখে অতিরিক্ত চাপ পরতে পারে, যা কিনা অসাস্থ্যকর, বিশেষ করে লম্বা কার্জঘন্টার ক্ষেত্রে। আপনার কাজের স্পেসের আলো তাই খুবই গুরুতবপূর্ণ কারণ এটি সেখানকার বাতাবরণ সৃষ্টি করে ও আপনার কর্মক্ষমতার উপর প্রভাব বিস্তার করে। আপনার বাড়ির অফিস আলোয় পরিপূর্ণ হওয়া চাই। আরো ভালো হয় যদি সেটা প্রাকৃতিক আলো হয়। তাই জানালার কাছে একটি কোণ তৈরি করতে পারলে চমৎকার হয়। আপনি যদি আপনার বাড়ির-অফিস জানালার কাছে করার সিদ্ধান্ত নেন তবে জানালায় যেন পর্দা থাকে সেটা নিশ্চিত করুন, যেন আপনি দিনের বিভিন্ন সময়ে আলোর প্রখরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অন্যথায় সূর্যের তীব্রতা উল্টো আপনার কাজের মনযোগ ব্যাহত করবে।
অন্যদিকে, যদি জানালার আশেপাশের কোন জায়গা না থেকে থাকলে, তবে একটি টেবিল ল্যাম্প জুড়ে নিলে ভালো হয়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে চোখের জন্য কোমল পরিবেশ সৃষ্টি করা যেন ক্লান্তি না আসে।
দৃশ্যপট
আমরা চোখের ওপর চাপ কমিয়ে আনার কথা বলছি তবে এটা অনেকটাই দৃশ্যপটের রঙের উপর নির্ভর করে। আপনি হয়তো আপনার দেয়াল নতুন করে রঙ করা শুরু করবেন না (এবং এই সামাজিক দুরত্বের সময় সেটা যেমন সম্ভব নয় তেমন সমীচীনও নয়), তবে তার মানে এই নয় যে আপনার কাজের স্পেসটির একটি আরামদায়ক রংচ্ছটা থাকবে না।
নানান জিনিসের মাধ্যমে রঙ যোগ করাটা খুব সোজা। যেমন একটি ছবি অথবা বুলেটিন বোর্ড যেখানে আপনি ছবি, শিল্পকর্ম সেঁটে রাখতে পারেন ( সাথে অবশ্যই জরুরি কাগজপত্র ও সাঁটানো নোটস)। এই ব্যাপারে আনুষঙ্গিক উপকরণে আরও জানতে পারবেন। আরামদায়ক রঙ পছন্দ করুন, যেমন সাদা, ধূসর, ও প্যাস্টেল । এতে আবহ আরামপ্রদ ও বরণীয় থাকবে।
অলঙ্করণ করা
যেমনটি আগের দফায় আলোচনা হলো, ঘরের অফিসে রঙ যোগ করার একটি সহজ ও মনোমূগ্ধকর পদ্ধতি হচ্ছে আনুষঙ্গিক উপকরণ যোগ করা। এটি করার কিছু সহজ উপায় হলোঃ
- ছবি: আপনার ঘরের অফিস একান্ত আপনার নিজস্ব ভাবে সাজানোর যায়গা। তাই নিঃসন্দেহে এতে আপনার ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া দিন। আপনি এখানে আপনার পরিবারের Travel এর ছবি রাখতে পারেন – এমন ছবি যেগুলো আপনাকে শান্ত করবে ও মনে প্রশান্তি আনবে। আপনি এগুলোকে স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে সেঁটে দিতে পারেন অথবা পিন দিয়ে বুলেটিন বোর্ডে লাগিয়ে রাখতে পারেন
- গাছ: সরস গাছ অথবা পাতাবাহার ব্যাবহার করেও আপনি আপনার আবহে প্রশান্তি নিয়ে আসতে পারেন। পটের গাছ শুধু আপনার দৃশ্যপটে রঙই যোগ করবে না, বরং বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে একটি শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
- স্টেশনারি: গোটা কয়েক আপনার পছন্দের বই শেলফে রেখে দেয়া যেতে পারে- এতে অফিস স্পেসটি আরও পরিচিত ও বরণীয় মনে হবে। একটি কলমদানিতে কলম, শার্পনার, এবং প্রয়োজনীয় জিনিস রাখুন। চিন্তাশীল সাজ্জা অনেক বড় একটি ভূমিকা রাখবে ও আপনাক প্রফুল্য রাখবে। যদিও পরামর্শ থাকবে যেন আপনি জাঁকজমকপূর্ণ জিনিস থেকে দূরে থাকেন যা আপনার মনোযোগ ব্যাহত করবে।
- বিবিধ:একটি দেয়াল ঘড়ি অথবা টেবিল ঘড়ি একটি দারুণ অলঙ্করণ যেটা আপনাকে কর্মমূখী রাখবে ও নান্দনিকভাবে ঠিক রাস্তায় রাখবে। আপনি একটি রঙিন কুশনও যোগ করতে পারেন আরও শোভাবর্ধণের জন্য। সীমিত ব্যাবস্থার মধ্যে একটি রঙের স্বতন্ত্রতা পালণ করা সম্ভব না হলেও আপনার উপকরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত রঙটি বেছে নেয়াটাই হবে সঠিক দিকে পা বাড়ানো।
জঞ্জালে এলোমেলো
বাড়ির অফিস বড় হোক বা ছোট, জঞ্জাল জমা স্বাভাবিক। এলোমেলোভাব এড়িয়ে চলার কিছু টিপসঃ
- শেলফের ব্যবহার: আপনার ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখার জন্য ডেস্কের পেছনে দেয়ালের সাথে শেলফ যোগ করুন অথবা বইয়ের শেলফ বা ফাইল কেবিনেট ব্যবহার করুন। এটি আপনার কাজের জন্য লভ্য জায়গা অনেকটা বাড়িয়ে দেবে।
- নিজে হাতে করুন: আপনার অস্থায়ী অফিসের অভিগম্যতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল যোগাড় করতে যদি হিমসিম খেয়ে যান, চিন্তা করবেন না। বিভিন্নভাবে আপনি নিজ হাতেই সেগুলো বানিয়ে নিতে পারেন, হয়তো সহজলোভ্য ঘরের জিনিস দিয়েই।একটি ডেস্ক অর্গানাইজারে আপনি ফাইল এবং কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে পারেন। নিচের চিত্রে নিজ হাতে ডেস্ক অর্গানাইজার তৈরি করার পদ্ধতি ধাপে ধাপে বর্ণনা করা আছে।চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে আপনি এই কাজটি ফেলে দেয়া কাগজের বাক্স দিয়েও করতে পারেন। ব্যাপারটা এতই সোজা
- আলাদা আলাদা কাজের জন্য পৃথক জায়গা স্থাপন করুন: গুছিয়ে রাখার আরেকটি কার্যকর উপায় হচ্ছে হাতের কাছের জিনিসগুলো ভাগ ভাগ করে রাখা। আপনি অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের কাগজ রাখার জন্য বিভিন্ন ফোল্ডার ব্যবহার করতে পারেন ও কোন ফাইলটি কিসের সেটা বোঝার জন্য লেবেল এঁটে দিতে পারেন। এবং ব্যবহারের পর কোনটা কোথায় রাখা হবে সেটাও ঠিক করে নিতে পারেন। মাস্কিং টেপ, মার্কার কলম অথবা সাধারণ কলম দিয়ে ফাইল লেবেল করা যেতে পারে, তবে নিশ্চিত করুন লেবেল যেন বড় ও বোধগম্য লেখায় হয়। ফাইল গোছানোর একটা সহজ বুদ্ধি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলোকে হাতের কাছে রাখা ও কম জরুরি ও অব্যবহৃত ফাইল ও ষ্টেশনারী দূরের দিকে রাখা।
যা দেখতে চান না তা সরিয়ে রাখা
তার ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় জিনিস উঁকিঝুঁকি মারলে একটা অপ্রীতিকর দৃশ্য তৈরি হয়। এমন একটি দৃশ্য যেটা স্পষ্ট চিন্তাশক্তি ব্যাহত করতে পারে। এরকম যত্রতত্রই হতে পারে, বিশেষ করে আপনি যখন বেশ কয়েকটা গ্যাজেট নিয়ে কাজ করেন। সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে আপনি যা দেখতে চাননা তা ঢেকে অথবা লুকিয়ে রাখা। তারগুলো টেপ দিয়ে আটকে দিয়ে বড় কোন জিনিসের পেছনে লুকিয়ে ফেলা যেতে পারে। অথবা আপনার ডেস্কের নিচে, চোখের আড়াল করে রাখা যেতে পারে। ভারি ও অনাকর্ষনীয় প্রিন্টারটিকে আলাদা আলমারি বা ক্লসেটে ঢুকিয়ে রাখুন। হাতের কাছে এমন ক্লসেট না থাকলে আরেকটি আলাদা নিচু টেবিলে রাখুন যেখান থেকে জিনিসটি আপনার ও আপনার স্নিগ্ধ কাজের আবহের মধ্যে বাধা হয়ে না দাড়াতে পারে।একইসাথে আপনার গোছানো কাজের স্পেসটি যেমন আরামদায়ক তেমনি যেন দেখতেও সুশ্রী হয়।
সামাজিক দূরত্ব বজার রাখা এই চলমান মহামারীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই সাতটি টিপস আপনাকে একটি অস্থায়ী হোম-অফিস তৈরিতে সাহায্য করবে, যেখানে আপনি কাজ করবেন এই জেনে যে ঘরে থেকে আপনি পৃথিবীকে সুস্থ হতে সাহায্য করছেন।
এই ব্লগ টি English এ পড়ুন
অনুবাদ: ডাঃ অধরা মাধুরী ওয়াদুদ
No Comments