পরিবেশ বান্ধব ডিজাইন বলতে বাসার ডিজাইনে এমন উপকরণের ব্যবহার করাকে বোঝায়, যা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে তাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এ ব্যাপারগুলোকে শুধুমাত্র কোনো দিবস কিংবা বইয়ের পাতাতেই লিপিবদ্ধ না রেখে আমরা নিজ নিজ ঘর থেকেই বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী গঠনে ভূমিকা রাখতে পারি।
ঘরের ইন্টেরিওর ডিজাইন হতে হবে দৃষ্টিনন্দন এবং একই সাথে পরিবেশ বান্ধব। ঘরের এমন ডিজাইনে থাকে সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রকৃতির স্পর্শ। পরিবেশ বান্ধব ডিজাইন শুধুমাত্র ঘরের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, বরং এতে বসবাসকারীদের শরীর এবং মনকে সতেজ রাখতেও সাহায্য করে।
আজকে আমরা এই ব্লগে জানব, ঘর সাজানোর ৬টি ইকো-ফ্রেন্ডলি বা পরিবেশ বান্ধব উপায়, যা আমাদের ইন্টেরিওর ডিজাইনে নিয়ে আসবে সতেজতার ছোঁয়া।
আলোকসজ্জা এবং স্থাপনকৌশল
ঘরের লাইটিং বা আলোকসজ্জা আমাদের ঘরের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। ঘরের যেকোনো রুমের ক্ষেত্রে আলোর সঠিক ব্যবহার বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে উপযোগী। সূর্যের আলোর ব্যবহারে একদিকে যেমন বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়, অপরদিকে প্রাকৃতিক এই আলো যোগান দেয় ভিটামিন ডি – এর। যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ঘরে প্রাকৃতিক আলোর সর্বাধিক উপযোগিতা পেতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন – ঘরের ডিজাইন করার সময় বেডরুম এবং বাথরুমের ডিজাইন উত্তর দিকে করা, যেখানে আলো কিছুটা কম আসে। অপরদিকে লিভিং রুম এবং কিচেনের ডিজাইন দক্ষিণ দিকে করা যেতে পারে। কারন, সেখানে আলোর প্রভাব কিছুটা বেশি। ঘরে রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালকা রঙের ব্যবহার করা উচিত, এতে ঘরকে উজ্জ্বল মনে হয়। ঘরের স্নিগ্ধতা বজায় রাখার জন্য ভারী পর্দার বদলে হালকা পর্দার ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে ঘরে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচল করতে পারে এবং ঘর থাকবে সতেজ।
যদি ঘরে বড় জানালা না থাকে, তবে বিভিন্ন ধরনের লাইট যেমন – বাঁশ কিংবা বেতে বাঁধানো টেবিল ল্যাম্প, পেন্ডেন্ট ল্যাম্প ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। যা ঘরকে দেয় প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়া। এছাড়া ঘরে সিএফএল কিংবা এলইডি লাইটের ব্যবহার আপনার বিদ্যুৎবিল কমানোর সাথে সাথে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণেও উপযোগী ভূমিকা রাখবে। এছাড়া উজ্জ্বল বাতির আলোর পরিবর্তে ফ্লুরেসেন্ট বাল্ব, হ্যালোজেন বাল্ব কিংবা ল্যান্টার্ন বাতির ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আপনার ইন্টেরিওরে এনে দিবে শান্তির পরশ।
রিডিউজ, রি-ইউজ এবং রিসাইকেল
পরিবেশ বান্ধব ইন্টেরিওর ডিজাইনের ক্ষেত্রে এই ৩টি জিনিসের এর বেশ গুরুত্ব রয়েছে। এই তিনটি বিষয় সামলাতে আপনাকে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন – পরিমিত জিনিসের ব্যবহার, অ-জীবাণুবিয়োজ্য জিনিসগুলোর পুনব্যবহার করা, নিত্যদিনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর উপাদান আছে এমন জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে আনা। এর উপায় নিয়ে বিস্তর কিছু আলোচনা করা যাক।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, নতুন কিছু কেনার পূর্বে বাড়িতে পড়ে থাকা বাড়তি জিনিসগুলোর ব্যবহার আপনি করতে পারেন। ঘরের অব্যবহৃত কাপড়গুলোকে একটু সৃজনশীল উপায়ে ঘরের চেয়ার, সোফা কিংবা কুশনের কভার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। পুরনো কাঠের দরজাকে অযত্নে ফেলে না রেখে, তা দিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারেন সেন্টার টেবিল, জানালার ফ্রেম কিংবা দেয়ালের মাপে বানিয়ে ফেলতে পারেন চাহিদা অনুযায়ী কোনো শেল্ফ। আবার ঘরে থাকা অপ্রয়োজনীয় গ্লাস কিংবা জারের ব্যবহার করতে পারেন সেগুলোতে ফুলদানী বানিয়ে কিংবা গাছ লাগিয়ে। আবার সেই জারগুলোকে সাজিয়ে করতে ফেলতে পারেন সুন্দর সব লাইটিং।
বায়ু চলন এবং প্রাকৃতিক বায়ু সংশোধক
জীবনে সুস্থ থাকার জন্য স্বভাবতই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের মানসিক বিকাশে সাহায্য করে, স্ট্রেস বা চাপ কমায় এবং আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখে। ঘরের মাঝেই প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়া ঘরের বায়ুকে রাখে নির্মল এবং ঘরের বাসিন্দাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ঘরের ইন্টেরিওরে সবুজের ছোঁয়া পেতে আমরা বারান্দা কিংবা ছাদে গাছ লাগাতে পারি। এছাড়া কিচেন গার্ডেনিংও করতে পারি। কিন্তু পরিবেশ বান্ধব বাগানের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।
ঘরের ভেতরে বাগান করার ক্ষেত্রে কিছু কৌশল রয়েছে। যেমন – অতিরিক্ত বাহারি কিছুর বদলে ঘরে শোভা পেতে পারে মানি প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট, লাকি ব্যাম্বু, রাবার প্ল্যান্ট কিংবা লতা-গুল্ম জাতীয় গাছ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে, গাছের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক সার কিংবা জৈব সার ব্যবহার করা। ঘরের ডিজাইনও ঘরে বায়ু সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপযুক্ত ডিজাইন দ্বারা বাড়ি তৈরী করলে সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের চলাচল বজায় থাকে।
ঘরে বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য এর চলাচলের ব্যবস্থা বড় একটি ভূমিকা পালন করে। বায়ু সঞ্চালনের সঠিক ব্যবস্থা থাকলে চুলা কিংবা রান্নাঘরের তাপ থেকে বের হওয়া গরম ভাপের পাশাপাশি কার্বন মনোঅক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডিঅক্সাইড থকে ঘরের বাতাসকে মুক্ত রাখা যায়। এছাড়া ঘরের দরজা ও জানালার অবস্থানও বাতাস সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
পরিবেশ বান্ধব আসবাব এবং ফ্লোরের ব্যবস্থা করা
আসবাবপত্র বাসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আসাবাবপত্রে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু থাকলে তা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আসবাপত্রে প্রায়ই এমন এক ধরনের তেল কিংবা মোমের ব্যবহার করা হয়ে যাতে ফর্মালডিহাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ থাকে, যা আমাদের শরীর এবং পরিবেশ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। তাই আসবাবপত্র নির্বাচনে পরিবেশ উপযোগী উপাদানের ব্যবহার উচিত।
আসবাবপত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন উপকরণ বেছে নিতে হবে যা পরিবেশ বান্ধব। যেমন – কাঠ কিংবা বেতের আসবাবপত্র। পরিবেশের ওপর এদের উপযোগিতা তো রয়েছেই, এর পাশাপাশি এই শিল্পগুলো আমাদের দেশীয়। তাই এ শিল্পের সমৃদ্ধিতে কাঠ, বাঁশ কিংবা বেতের আসবাবপত্র কিনে আমারা দেশীয় শিল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারি।
ঘরের মেঝে বাড়ির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাড়ির অন্যান্য অংশের মতো মেঝের ক্ষেত্রেও পরিবেশে বান্ধব ব্যাপারটিকে মাথায় রাখতে হবে। প্লাস্টিক জাতীয় উপাদানের পরিবর্তে মেঝেতে চুনাপাথরের টাইলস, কাঠ কিংবা শক্ত বাঁশের ব্যবহার করা যেতে পারে। রান্নাঘর, বাথরুম কিংবা ঘরের মেঝেতে বাঁশের ব্যবহার আনবে নতুনত্বের ছোঁয়া।
পর্দা এবং কার্পেটের জন্য কাপড় নির্বাচন
ঘরের ব্যবহার্য আনুষঙ্গিকের জন্য এমন কিছু ব্যবহার করা উচিত যা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহীত হয়েছে। সিনথেটিক উপাদান যেমন- নাইলন, পলিসটার এগুলো প্লাস্টিকের আরেকটি রূপ। কুশন, পর্দা, চাদর, কার্পেট নির্বাচনে সিনথেটিক উপকরণ আছে এমন কিছু বাদ দিতে হবে। এর পরিবর্তে প্রাকৃতিক তন্তু যেমন- সুতি, জুট কিংবা সিল্কের জিনিস ব্যবহার করতে হবে।
জুটের তৈরি কার্পেট ঘরে একটি শান্ত আবহের সৃষ্টি করে, এছাড়া জুটের তৈরি পণ্য বেশ টেকসইও হয়ে থাকে। বাঁশ কিংবা বেতের তৈরি জিনিস ঘরে প্রাকৃতিক এক আবেশের ছোঁয়া দেয়। এসব প্রাকৃতিক উপাদান পুনরায় নির্মাণযোগ্য এবং পরিবেশ বান্ধব। আরেকটি বড় ব্যাপার, এই জিনিসগুলোর ব্যবহার করে আমরা আমাদের দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে পারি।
এছাড়া ঘরের সৌন্দর্যে ব্যবহার্য কাপড়ের ক্ষেত্রে আমরা অর্গানিক কাপড়গুলো কিনতে পারি। সেই কাপড়ে বিভিন্ন রঙিন ফল, ফুল, সবজি যেমন – লেবু, জাভা পাম কিংবা অপরাজিতা ফুল থেকে নেয়া প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী রঙ করতে পারি। ঘরের বাড়তি সৌন্দর্যে এই DIY আমাদের সৃজনশীলতার পাশাপাশি ঘরের সৌন্দর্যও বাড়িয়ে দেয়।
রঙ
বাড়ির দেয়ালের রঙ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই একে অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে। কিছু কিছু দেয়ালে বিষাক্ত উদ্বায়ী জৈব যৌগের ব্যবহার করা হয়ে থাকে – যা আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। এই রঙগুলো ব্যবহারের ফলে বমি, এলার্জি সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। দেয়ালে বিষাক্ত জৈব যৌগের এই রঙ থেকে এক ধরনের ক্যামিকেলের গন্ধ ও গ্যাস বের হয়। কিন্তু এই রঙের পরিবর্তে যদি দেয়ালে এমন রঙ ব্যবহার করা হয় যাতে এই বিষাক্ত উদ্বায়ী জৈব যৌগের ব্যবহার নেই, তবে তা আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশ বান্ধব হবে। তাই রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন রঙ বেছে নিতে হবে যাদের ওপরে “Low Odor/VOC” লেখা থাকবে এবং অ্যাসিটোন ও ফর্মালডিহাইড মুক্ত থাকবে।
রঙ করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অভ্যাসও গড়ে তুলতে হবে। যেমন- রঙ করার জন্য যে পেইন্ট ট্রে ব্যবহার করে থাকি তার পরিবর্তে বাঁশের ট্রে ব্যবহার করতে পারি। আবার বাজারে পাওয়া কৃত্তিম পেইন্টিং ব্রাশের পরিবর্তে বাঁশের তৈরি প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করতে পারি। এছাড়া দেয়ালের সৌন্দর্যবর্ধনে অর্গানিক ওয়াল-পেপার ব্যবহার করতে পারি, যা প্রাকৃতিক রঙ এবং পুনঃ ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু এই ওয়াল পেপারগুলোতে অনেক সময় এক ধরনের আঠা কিংবা রঞ্জক পদার্থ থাকে যাতে বিষাক্ত উদ্বায়ী জৈব যৌগ (VOC) ব্যবহার করা হয়। তাই ওয়াল-পেপার নির্বাচনেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
ঘর সাজানোর জন্য আমাদের চারপাশে পরিবেশ বান্ধব অসংখ্য উপাদান আছে। আমাদের উচিত এসব উপাদানের মধ্যে থেকে নিজেদের জন্য পছন্দসই উপাদানগুলো বেছে নেয়া। আর আজকের এই ব্লগটিতে আমরা সে সম্পর্কেই জানলাম।
পরিবেশ বান্ধব উপায়ে নিজেদের ইন্টেরিওর সাজাতে প্রফেশনালদের সহযোগিতা পেতে চাইলে, যোগাযোগ করতে পারেন এখানে – Sheraspace!
এই ব্লগটি English এ পড়ুন।
অনুবাদ: জান্নাতুল তাজরিয়া ফার্সি
No Comments