টেরাকোটা – যা বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসে পোড়ামাটি হিসেবে পরিচিত, তার উদ্ভাবনী রূপের বর্ণালী দিয়ে আধুনিক ইন্টেরিওর ডিজাইনের জগতে পা রেখেছে। টেরাকোটা শব্দটির ব্যবহার বর্তমানে মুরাল, মাটির জিনিসপত্র, ভাস্কর্য থেকে শুরু করে রঙ এবং থিম হিসেবেও প্রসারিত হয়েছে। টেরাকোটার প্রাচীন ধাঁচ আর কাদামাটির স্পর্শের কারণে ইন্টেরিওর ডিজাইনের এর ব্যবহার একটি কালজয়ী সংযোজন – তা হোক আপনার বাসা, অফিস কিংবা রেস্তোরাঁ।
বাংলাদেশে টেরাকোটা
যুগে যুগে দক্ষ মাটির কারিগররা কাদামাটি এবং কাদা মিশ্রিত করে নানান আকারের বিভিন্ন গৃহস্থালীর পণ্য তৈরি করেছেন। কুমারের চাকার একটি ঘূর্ণনেই লালচে কমলা রঙের (কাদামাটির পোড়া রঙ) পণ্য তৈরি হতো, যার বাজারমূল্যও ছিল সুলভ এবং চাহিদাও ছিল বহুল। ধীরে ধীরে চকচকে এবং ব্যয়বহুল চীনামাটির বাসন জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করার কারণে কাদামাটির সাথে সংযুক্ত সব জিনিসের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা কমতে থাকে। তবে আমরা প্রগতিশীল আধুনিক যুগে পা রাখার সাথে সাথে টেরাকোটা আবার তার যথাযথ প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসছে। তাই হোক পহেলা বৈশাখ কিংবা পূজা-পার্বন, বাড়ির সজ্জার জন্য পোড়ামাটির বা কাদামাটির ডিশ এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী টেরাকোটার কারুশিল্প ব্যবহার করে বিস্তৃত টেবিল সেটআপ এখন প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। যে কোন দিনকে পুরোপুরি বাঙালিয়ানার আমেজে বরণ করে নিতে টেরাকোটার ব্যবহার সত্যিই একটি শৈল্পিক উপায়!
একটি উপায় যার মাধ্যমে টেরাকোটা স্পষ্টতই আমাদের জীবনে রয়ে গেছে তা হলো ‘আড়ং’ এর হস্তশিল্প। ঘণ্টা, অ্যাশট্রে, ধূপধারী, ফুলদানি, কলমদানি এবং এমনকি পোড়ামাটির তৈরি পায়ের স্ক্রাবগুলি প্রথম থেকেই ‘আড়ং’ এর বিভিন্ন তাকে প্রদর্শিত ছিল, যার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশ জুড়ে হাজার হাজার গ্রামীণ কারিগরদের নিজস্ব কাজের বিভিন্ন রূপও উদযাপিত হয়েছে। পোড়ামাটির বহুমুখি ব্যবহারের কারণে এটি দিয়ে নানান ধরনের পণ্য নানানভাবে তৈরি করার সুযোগ রয়েছে – কখনও প্লেইন এবং কখনও পালিশ করা বা হাতে আঁকা, তবুও প্রতিটি জিনিসই সমানভাবে শৈল্পিক, অনন্য ও সুন্দর।
মুরাল এবং কারুকার্যখচিত ইন্সটলেশন
আপনার বাসা বা রেস্তোরাঁ যার জন্যেই হোক না কেন, পোড়ামাটির তৈরি মুরাল হতে পারে একটি নিখুঁত, নিরবধি সংযোজন। আপনার বাসার হল বা বাগানে প্রকৃত পরিবেশ তৈরির জন্যে আপনি টেরাকোটার মুরাল ব্যবহার করতে পারেন।
আজকাল অনেক রেস্তোরাঁর মালিকরাই তাদের রেস্তোরাঁর জন্য একটি নির্দিষ্ট থিম চান। তাই আপনি যদি আপনার রেস্তোরাঁর ভেতরে ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের পরিবেশ আনতে চান, তাহলে আপনি টেরাকোটা থিম ব্যবহার করাতে পারেন। টেরাকোটার মাটির পাত্র বা অন্যান্য টুকরো সহজেই একটি দেয়াল অলঙ্করণে ব্যাবহার করা সম্ভব ।
এমনকি আপনার রেস্তোরাঁর ভেতরে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য যোগ করতে আপনি পোড়ামাটির ব্লক বা এমনকি পোড়ামাটির ঘন্টা বা হাঁড়ি দিয়ে আপনার সিলিং সজ্জিত করতে পারেন।
ওয়াল পেইন্ট (দেয়ালে আঁকিবুঁকি)
টেরাকোটা মানে এখন আর শুধু মাটির তৈরি জিনিসপত্রই নয়, টেরাকোটা এখন নিজেই একটি রঙ, এমনকি থিমও। তাই অনেক হালকা রঙের ব্যবহারের মাঝে একটি রঙিন ভাব ফুটাতে কিংবা ঘরের পরিবেশে খানিকটা উষ্ণতা আনতে আপনি ভিন্নধর্মী দেয়াল সাজিয়ে তুলতে পারেন একটি ছোট্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে – আপনার দেয়ালকে টেরাকোটা রঙে রাঙিয়ে দিন। এটি আপনার ঘরের অভ্যন্তরকে একটি আকর্ষণীয় সমসাময়িক চেহারা দেবে। এটি শুধু আপনার দেখার আরামকেই বৃদ্ধি করবে না, আপনার ঘরের স্টাইল এবং নান্দনিকতাকেও বহুগুণে বাড়িয়ে দিবে। একইসাথে, টেরাকোটা রঙ হিসেবে একটি বহুমুখী রঙ যা অন্যান্য অনেক শেডের সাথেই ভালোভাবে মিশে যায়, এমনকি বাঙালিয়ানা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের স্টাইলের সাথে এই রঙ মানানসই।
সজ্জায় উষ্ণতা
টেরাকোটা রঙের রঙিন ফ্যাব্রিক সোফা আপনার ঘরের ভেতরের সজ্জায় এক ধরনের চমৎকার স্পন্দন আনতে সাহায্য করবে। যেহেতু এই ধরনের রঙের আসবাব এখনও খুব পরিচিত হয়ে ওঠে নি, তাই এটি শুধু উৎকৃষ্টতাই নয়, আপনার ঘরের সজ্জায় অনন্যতাও নিয়ে আসবে। সোফার সাথে মিলিয়ে সোফার কুশন বা বালিশ এবং কার্পেটের রঙের সমন্বয় করতে পারলে এর মাধ্যমে আপনার ঘরে আভিজাত্যের ভাবও আনা সম্ভব।
আপনার ঘরের রঙ বেশ হালকা হয়ে থাকলে, টেরাকোটা রঙের পর্দা ব্যবহার করতে পারেন। এটি অবশ্যই আপনার ঘরের সৌন্দর্যকে অভাবনীয় উপায়ে ফুটিয়ে তুলবে। অনায়াসে প্রচলিত এবং আকর্ষণীয় দর্শনের জন্য পোড়ামাটির পেনড্যান্ট লাইট ব্যবহার করতে পারেন – যা বিভিন্ন আকার এবং সাইজে সহজলভ্য। প্রকৃতপক্ষে এই রঙের সাথে ঘর সজ্জার সম্ভাবনা অবিরাম।
টাইলস
আপনার বাগান কিংবা ঘর যার জন্যেই হোক না কেন, টেরাকোটার টাইলস ব্যবহার করে আপনি একটি ভিন্নধর্মী আবহ তৈরি করতে পারবেন। টেরাকোটার টাইলস ব্যবহার করার সময় আপনার সৃজনশীলতার কোনও সীমা বেঁধে রাখার প্রয়োজন নেই। এর ব্যবহার আপনার ঘরের ভেতর চূড়ান্ত স্বাচ্ছন্দ্য এবং শিথিলতার পরিবেশ তৈরি করে।
ছোট টেরাকোটার টেক্সচারযুক্ত টাইলস চমৎকার সজ্জা সংযোজন। এই টাইলস বিভিন্ন চিত্র, দৃশ্যাবলী, ডিজাইন এবং রঙের হয় – যা একটি accent wall এর জন্য একেবারে উপযুক্ত।
বাসনপত্র
টেরাকোটার বাসনপত্র শুধু ‘পহেলা বৈশাখ’ এর মতো দিনে ব্যবহারের জন্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াতে আপনি টেবিল সাজাতে টেরাকোটার কাপ বা বাসনপত্র টেবিলের মধ্যমণি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। নৈশভোজের দাওয়াতেও যে কোন সময় আপনি এই ধরনের আসবাবগুলো ব্যবহার করতে পারবেন, যা বেশ সাবলীলভাবেই নজর কাড়তে সক্ষম।
টেরাকোটা এবং গাছপালাদি
প্রাচীন টেরাকোটার পাত্রে সবুজ গাছ এমন একটি সংমিশ্রণ যা শাস্ত্রীয়ভাবেও চিরস্থায়ী। সমতল, প্যাটার্নযুক্ত, খোদাইকৃত কিংবা বিভিন্ন রঙে রঙিন – যেরকমই হোক না কেন, টেরাকোটার পাত্র বাগানে ব্যবহারকৃত অন্য যে কোন পাত্রের তুলনায় শ্রেষ্ঠতম।
নিজ পছন্দ মতো একটি গাছ বেছে নিয়ে সেটিকে আপনার পছন্দের মাটির পাত্রে রাখুন, যা কি না আপনার বেডরুম, বসার ঘর বা রান্নাঘরের সজ্জায় সুন্দর একটি প্রভাব ফেলবে । আপনি চাইলে metal হ্যাঙ্গারে গাছের হাঁড়ি স্থাপন করে একটি ঝুলন্ত বাগানও তৈরি করতে পারেন। একটি মই শেলফও পোড়ামাটির পাত্র প্রদর্শনের জন্যে ব্যবহার করা যেতে পারে যা আপনার বাগানের নানন্দিকতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুরাল থেকে শুরু করে, বাসনপত্র, ঘর সজ্জা কিংবা দেয়াল সাজানোর উপকরণ, এমনকি আসবাবপত্র বা পর্দার রঙ – টেরাকোটার বিচরণ সবক্ষেত্রেই। আশা করি আমাদের এই ব্লগে আলোচিত টেরাকোটার নানাবিধ ব্যবহার পড়ে আপনিও আপনার বাসার ইন্টেরিওর ডিজাইনে তা ব্যবহার করতে আগ্রহী হবেন।
টেরাকোটার স্পর্শে আপনার ঘরকে সাজাতে পেশাদারি সাহায্যের প্রয়োজন হলে দেরী না করে আজই Sheraspace এর সাথে যোগাযোগ করুন!
এই ব্লগ টি English এ পড়ুন
অনুবাদ: নাজিয়া বিনতে শফিক
No Comments